শ্রীগদাধর পণ্ডিত : মহাপ্রভুর ছায়া

 

শ্রীগদাধর পণ্ডিত

শ্রীগদাধর পণ্ডিত : মহাপ্রভুর ছায়া

শ্রীগদাধর পণ্ডিত শিশু কাল থেকেই মহাপ্রভুর সঙ্গেই থাকতেন । তাঁর পিতার নাম ছিল মাধব মিশ্র আর মাতার নাম ছিল রত্নাবলীদেবী । তাঁরা মায়াপুরে জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ীর নিকটে বাস করতেন আর শচীদেবীকে বড় বাগ্নীর মত দেখতেন ।

শিশুর লীলার সময় শ্রীগৌরহরি গদাধর পণ্ডিতের সঙ্গে খেলা করতেন । যদিও গদাধর পণ্ডিতের বয়সে মহাপ্রভুর কয়েক বছর ছোট, তাঁরা গ্রামের পাঠশালায় একসঙ্গে অধ্যয়ন করতেন । মহাপ্রভু কোন সময় গদাধর ছাড়া থাকতে পারতেন না আর গদাধরও মহাপ্রভুর ছাড়া একক্ষণও থাকতে পারতেন না । (দ্বাপর-যুগে ব্রজে তিনি স্বয়ং শ্রীমতীরাধারাণী ছিলেন ।)

এক দিন শ্রীঈশ্বর পুরী মায়াপুরে গিয়ে গদাধরকে কৃষ্ণ-লীলামৃত নামে গ্রন্থ অধ্যায়ন করালেন আর গদাধর পণ্ডিত সেই গ্রন্থ তাঁর শ্রীমুখে শুনে বিমুগ্ধ হলেন । গদাধর পণ্ডিত শৈশবকাল থেকে ধীর, শান্ত, নির্জন এবং বৈরাগ্যবান ছিলেন । শৈশবে গৌরহরি খুব চঞ্চলভাব প্রকট করে মাঝে মাঝে তাঁকে ন্যায়ের ফাঁকি জিজ্ঞেস করতেন আর গদাধর পণ্ডিত তা বিশেষ পছন্দ না করে কখনো তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইতেন (মাঝে মাঝে নিমাইকে রাস্তায় দেখে তিনি উল্টা দিকে ঘুরে তাঁকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতেন ।) কিন্তু গৌরসুন্দর তাঁকে ছাড়তেন না ।

এক দিন গদাধর পণ্ডিত মহাপ্রভুর কাছে এসে বললেন, “প্রভু, আমাকে দীক্ষা দাও ।” কিন্তু মহাপ্রভু বললেন, “তোমার গুরু আসছেন । ও তোমাকে ঠিক দীক্ষা দিয়ে দেবে ।”

কিছু পরে চট্টগ্রাম থেকে শ্রীপুণ্ডরীক বিদ্যানিধি নবদ্বীপে এলেন । মহাপ্রভু তাঁকে সব সময় “বাবা” বলে ডাকতেন ।

এক দিন মুকুন্দ দত্ত গদাধর পণ্ডিতের কাছে গিয়ে বললেন, “প্রভু, তুমি কি বৈষ্ণব দেখতে চাও ?”

গদাধর পণ্ডিত বললেন, “হ্যাঁ, নিশ্চয় ! চল ।”

যখন তাঁরা পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির বাড়ি এসেছিলেন, তখন গদাধর পণ্ডিত যে বিশেষ শ্রদ্ধা নিয়ে এসেছিলেন, সেটা হারিয়ে ফেললেন :

তিনি দেখলেন যে, পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি গৃহস্থ ভক্ত ছিলেন—তিনি পালঙ্কে আরামে শুয়ে দামী ধুতি ও ভাল জামা পড়তেন আর পান খেতেন । গদাধর পণ্ডিত তো সাধু দেখতে এসেছিলেন কিন্তু সাধু দেখতে লাগছে বিষয়ীর মত—তাঁর একটা অপরাধ হয়েছিল । গদাধর পণ্ডিত ভাবলেন, “এ লোকটা কী ? বৈষ্ণব হয়ে এক বিষয়ীর মত ব্যাবহার কেন ?” মুকুন্দ দত্ত তাঁর মন বুঝতে পেয়ে একটা কৃষ্ণলীলা শ্লোক কীর্ত্তন করলেন :

অহো বকী যং স্তনকালকূটং
জিঘাংসয়াপায়য়দপ্যসাধ্বী ।
লেভে গতিং ধাক্র্যবিতাং ততোঽন্যং
কং বা দয়ালুং শরপং ব্রহেম ॥

“অহো কি আশ্চর্য্য ! বকাসুরভগিনী দুষ্টা পূতনা কৃষ্ণবিনাশেচ্ছা-প্রণোদিত হইয়া কালকূট মিশ্রিত স্তন পান করাইয়াও ধাত্রীপ্রাপ্য গতি লাভ করিয়াছিল ; অতএব, কৃষ্ণ বিনা এমন আর কে দয়ালু আছে যে, তাঁহার শরণাপন্ন হইব ?”

(ভাঃ ৩/২/২৩)

মুকুন্দের অতিসুমধুর কন্ঠে কৃষ্ণলীলাগীত শুনে পুণ্ডরীকবিদ্যানিধি অমনি “কৃষ্ণ ! কৃষ্ণ !” বলে কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছিত হয়ে পড়লেন । গদাধর পণ্ডিতের এবার মনে হল, “না বুঝে হেন মহাভাগবত পুরুষকে বিষয়ী-জ্ঞান করেছি ! আমার অপরাধ হয়েছে ! তাঁর কাছে মন্ত্র গ্রহণ না করলে আমি নিস্তার পাব না—আমার অপরাধ দূর হবে না ।”

মহাপ্রভু তাঁকে “বাবা” বলে ডাকতেন কেন ? কারণটাই আছে । এই শ্রীপুণ্ডরীক বিদ্যানিধি দ্বাপর-যুগে ছিলেন রাজা বৃষভানু, শ্রীমতী রাধারাণীর বাবার অবতার । আর গদাধর পণ্ডিত কে হচ্ছে ? গদাধর পণ্ডিত হচ্ছে রাধারাণীর অবতার । সেইজন্য যখন গদাধর পণ্ডিত মহাপ্রভুকে কী হয়েছিল বললেন, তখন মহাপ্রভু তাঁকে বললেন, “তোমার অপরাধ খণ্ডন করবার জন্য ওঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিতে হবে ! ওই তোমার গুরু হবে !”

তখন এক দিন মুকুন্দ দত্ত পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির নিকটে গদাধর পণ্ডিতের সবিশেষ পরিচয় বলে দিলেন আর সেটা শুনে পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি হাসলেন:

শুনিয়া হাসেন পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি ।
“আমারে ত’ মহারত্ন মিলাইলা বিধি ॥
করাইমু ইহাতে সন্দেহ কিছু নাই ।
বহু জন্ম-ভাগ্যে সে এমত শিষ্য পাই ॥

(চৈঃ ভঃ ২/৭/১১৭-১১৮)

“এঁকে শিষ্য করে আমি কৃতার্থ হলাম ! তাই আমি এঁকে কৃপা করলাম না, উনি আমাকে কৃপা করলেন যে আমি এঁর মত শিষ্য পেলাম !”

গদাধর পণ্ডিত পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির সামনে গিয়ে প্রণাম করলেন আর পুণ্ডরীক বিদ্যানিধি তাঁকে মন্ত্র দিলেন । যখন গদাধর পণ্ডিত বাড়ি ফিরে এলেন, তখন তিনি এবার নতুন জীবন প্রকট করলেন—অহর্নিশি কৃষ্ণপ্রেমে ভাসতে লাগলেন ।

গদাধর পণ্ডিত ও মহাপ্রভু নদীয়া লীলার এক সঙ্গে থাকতেন, আর যখন মহাপ্রভু সন্ন্যাস লীলা করলেন, গদাধর পণ্ডিত তখন মহাপ্রভুর আদেশে ক্ষেত্র-সন্ন্যাস গ্রহণ করে নিলাচলে বাস করতে লাগলেন—তিনি ওখানে মহাপ্রভুর ছায়ার মত থাকতেন । শ্রীলশ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ গদাধর পণ্ডিতের সম্বন্ধে প্রণাম মন্ত্র রচনা করেছিলেন :

নীলামভোধিতটে সদা স্ববিরহাক্ষেপান্বিতং বান্ধবং ।
শ্রীমদ্ভাগবতীকথা মদিরয়া সঞ্জীবয়ন ভাতি য়ঃ ॥
শ্রীমদ্ভাগবতং সদা স্বনয়নাশ্রূপায়ণৈঃ ণূজয়ন্ ।
গোস্বামিপ্রবরো গদাধরবিভুর্ভূয়াৎ মদেকাগতিঃ ॥

“যখন মহাপ্রভু অন্তরে বিরহ-জ্বালায় জ্বলে পুড়ে মরছিলেন, তখন নীলামভোধি তটে বসে বসে গদাধর পণ্ডিত তাঁর সম্মুখে শ্রীমদ্ভাগবতম পড়তেন । তাঁর প্রিয় ব্যথিত বন্ধুকে উন্মাদ দেখিয়ে তাঁকে কিছু উপশম করবার জন্য গদাধর পণ্ডিত কৃষ্ণলীলা-পাঠ করতেন । পড়তে পড়তে তিনি চোখের জল ফেলেছিলেন আর সেই চোখের জল পুষ্পাঞ্জলির ন্যায় ভাগবতের উপরে পড়ত । সেই মহাপুরুষ গোস্বামীর শ্রেষ্ঠ গদাধর পণ্ডিতের তৃপ্তিটা এই গ্রন্থ রচনা করতে করতে আমারই একটি মাত্র উদ্দেশ্য হউক ।”

মহাপ্রভুর আদেশে ক্ষেত্র-সন্ন্যাস নিয়ে গদাধর পণ্ডিত শ্রীটোটা-গোপীনাথ-বিগ্রহের সেবা করতেন । উড়িষ্যার ভাষায় ‘টোটা’ মানে ‘বাগান’ ।

এক দিন মহাপ্রভু গদাধর পণ্ডিতের কাছে গিয়ে বলছেন, “গদাধর, আজকে আমি তোমাকে একটি দারুন উপহার দেব !”

গদাধর পণ্ডিত উত্তেজিত হয়ে গেলেন, “দাও না, প্রভু ।”

তখন মহাপ্রভু তাঁর সঙ্গে এক বাগানে গেলেন আর সেখানে খুঁড়তে খুঁড়তে বালির মধ্যে একটি দারুন বিগ্রহ বের করলেন—বিগ্রহটি পেয়ে তিনি বললেন, “ এই তো তোমার উপহার !”

সেই কাল থেকে গদাধর পণ্ডিত এই বিগ্রহের (শ্রীটোটা-গোপীনাথের) সেবা করতেন ।

এক সময় গদাধর পণ্ডিত ভাবলেন, “মহাপ্রভু সব সময় বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর আমি কোথাও যেতে পারছি না । আমি সব সময় শুধু পূজা করে যাচ্ছি...” মহাপ্রভুর সঙ্গে যেতে ইচ্ছা করে তাঁর মন খারাপ হয়ে গেল ।

এক দিন মহাপ্রভু চলে যেতে যাচ্ছিলেন । গদাধর পণ্ডিত তাঁর পিছনে পিছনে গেলেন । মহাপ্রভু ঘুরে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কোথায় যাচ্ছ ?”

গদাধর পণ্ডিত তাঁকে খুলে বললেন, “আমি তোমার সঙ্গে যাব !”

মহাপ্রভু বললেন, “তোমার কি সেবা নেই ? তোমায় কে অনুমতি দিয়েছে ? তুমি কি ভাবছ যে, তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে লোকের বাড়ি বাড়ি থাকবে আর ভালোমন্দ খাবে না কি ?”

গদাধর পণ্ডিত চালাকি করে বললেন, “না, না, আমি মোটেই তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না । আমি আইকে (শচীদেবী মাকে) দেখতে যাব !”

“শুন, তোমার সেবা আছে । তুমি সেবা ছেড়ে এখান থেকে যাবে না । গোপীনাথের সেবা কর !”

গদাধর পণ্ডিত তখন কী বললেন ? তিনি খুলে বলে ফেললেন, “তোমার সেবা করলে কোটী গোপীনাথের সেবা হয়ে যাবে ! আসলে তোমার চরণের দর্শন করলেই, কোটি গোপীনাথের সেবা তুল্য হয় না ।”

“চুপ ! একদম চুপ ! একটা কথাও নয় ।” মহাপ্রভু তাঁকে নিলেন না—যখন তিনি নৌকায় উঠে বসলেন, তখন গদাধর পণ্ডিত সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়লেন । সেরকম ছিল তাঁর প্রীতি ।

তাই গদাধর পণ্ডিত কখনও পুরীধাম ছেড়ে গেলেন না । তিনি প্রত্যেক দিন গোপীনাথের সেবা করতেন । যখন গদাধর পণ্ডিত বয়স্ক হয়ে গেলেন, তিনি এক দিন গোপীনাথের কাছে গিয়ে প্রার্থনা করলেন, “প্রভু, আমি অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে গিয়ে আর তোমার সেবা করতে পারছি না ! তোমাকে আমি কাপড়-চোপড়, গলায় মালা পর্যন্ত পড়াতে পারছি না । ঠিক মত কিছু করতে পারছি না । প্রভু, তুমি আমাকে সেবা থেকে মুক্তি দাও ।”

তখন তাঁর প্রিয় ভক্তের নিবেদন শুনে ভগবান তাঁর ভক্তের সেবার জন্য বসে পড়লেন ! প্রেমময় অন্বেষণ (Loving search for the lost servant) । পরের দিন গদাধর পণ্ডিত সকালবেলা মঙ্গলারতির সময় উঠে মন্দিরে গেলেন আর কী দেখলেন ? গদাধর পণ্ডিতের সেবা নেওয়ার জন্য গোপীনাথ বসে পড়েছিলেন ।

মহাপ্রভু কোথায় বিলীন হয়ে গেছেন—সেই বিষয়ের সম্বন্ধে বিভিন্ন ইতিহাসও আছে । কেউ বলেন যে, তিনি জগন্নাথ মন্দিরে গিয়ে জগন্নাথের সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছেন, আবার কেউ বলেন যে, তিনি এই টোটা গোপীনাথের মন্দিরে প্রবেশ করে আর বের হন নি—তিনি গোপীনাথের ঊরুর মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন । এখনও আপনি দেখতে পাবেন যে, গোপীনাথের ঊরুর মধ্যে কিছু রক্তের দাগ আছে । দুটো কথা আছে, দুটোই ঠিক ।

প্রায় প্রতি দিন গদাধর পণ্ডিত আবোনা শাক রান্না করতেন আর মহাপ্রভুকে নিমন্ত্রণ করতেন । মহাপ্রভু তাঁর কাছে চলে এসে প্রসাদ পেয়ে খুব খুশি ছিলেন । আর এক দিন গদাধর পণ্ডিত ভাবলেন, “দেখি, আমি শাক রান্না করব আর ও নিমন্ত্রণ ছাড়া আসবে কি আসবে না ? আমায় কতটা ও মনে রাখে ? কতটা ওর আমার প্রতি টান আছে ? আমি সেটা দেখতে চাই ।” তাই সেই দিন তিনি আবোনা শাকাদি রান্না করেছেন আর নিত্যানন্দ প্রভুও ভক্তগণকে নিমন্ত্রণ করলেন—তাঁরা সবাই চলে আসলেন । কিন্তু মহাপ্রভুকে নিমন্ত্রণ না করলে তিনি ভাবলেন, “ও আসবে কি আসবে না ?” হঠাৎ করে মহাপ্রভু এসে বললেন, “কী, গোসাঞি, শাক ভাল ভাল রান্না করছ আর আমাকে নিমন্ত্রণ করছ না ? আমাকে ফাঁকি দিচ্ছ নাকি ? আমাকে ফাঁকি দিলে চলবে না !” তারপর গদাধর পণ্ডিত খুশি হয়ে মহাপ্রভুকে বসিয়ে প্রসাদ দিলেন ।

 জয় শ্রীটোটাগোপীনাথ কি জয় !

জয় শ্রীগদাধর পণ্ডিত গোস্বামী প্রভু কি জয় ।

Post a Comment

0 Comments